পলাশীর প্রান্তর থেকে ধানমন্ডি : হিমালয়সম বিশ্বাসের নির্মম সংহার
সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা সাধের সেনাপতি আর বিশ্বাসভাজনদের ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পরই মূলত ভারতবর্ষে ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় নবাবকে। তার প্রায় সোয়া ২’শ বছর পর ১৯৭৫ সালে আবারও একটি বৃহস্পতিবারের রাত। রাত নয়, কালরাত হয়ে আসে বাঙালির ইতিহাসে। ততক্ষণে দিন-পঞ্জিকায় ১৫ আগস্ট গণনা শুরু হয়ে গেছে। ইতিহাসের জঘন্যতম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৯৭৫ সালের এই কালরাতে। এদিন গোটা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিল সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল কিছু বিপথগামী সদস্য। সেদিন রাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনে ঘাতকের নির্মম বুলেট বিদ্ধ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বুক।
আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস।
অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু ঘাতকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও খুনিদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘তোরা কী চাস? আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি?’ বঙ্গবন্ধুকে দেখেও হাত কাঁপেনি খুনিদের। গুলি চালিয়েছে খুনে চাহনীতে।
সেদিন ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের, কর্নেল জামিল।
খুনিদের বুলেটে সেদিন আরও প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু খানসহ অনেকে। ওই সময় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো বাঙালি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না বলে দৃঢ়বিশ্বাস করতেন বঙ্গবন্ধু। সে জন্য তিনি গণভবনের পরিবর্তে থাকতেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে। যে বাড়িটি বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন দেন।
আজ সরকারি ছুটি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে চরম অবহেলিত থাকতো জনক হারানোর দিনটি।
দিনটি সরকারিভাবে শোক দিবস হিসেবে পালিত হবে। আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি ভবনে উড়বে কালো পতাকা।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে। তবে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকারী পাঁচ আত্মস্বীকৃত খুনির ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়।
দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন। যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হবে।
যান চলাচলে ডিএমপির নির্দেশনা
১৫ আগস্ট রাজধানীতে গাড়ি চলাচলে ডিএমপির নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এদিন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গসহ বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণ রাজধানীর ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন।
ওইদিন ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে গণপরিবহনযোগে ও হেঁটে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের আগমন হবে ধানমন্ডিতে। এ উপলক্ষে ধানমন্ডি-৩২ এর চারপাশে রাস্তায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
গত শনিবার ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের যানবাহন সুষ্ঠুভাবে চলাচল ও যানজট পরিহারের লক্ষ্যে ধানমন্ডি-৩২, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর এলাকায় চলাচলরত গাড়িচালক বা ব্যবহারকারীদের ১৫ আগস্ট ভোর থেকে অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত গমনাগমনের জন্য নিচের পথ অনুসরণের অনুরোধ করা হলো-
১. মিরপুর-গাবতলি থেকে রাসেল স্কয়ার–আজিমপুর অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–ধানমণ্ডি-২৭ থেকে ডানে মোড় নিয়ে সংকর–জিগাতলা–সায়েন্স ল্যাব হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
২. নিউমার্কেট ও সায়েন্স ল্যাব থেকে রাসেল স্কয়ার অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন ধানমণ্ডি-২নং রোড থেকে বামে মোড় নিয়ে জিগাতলা–সংকর (সাতমসজিদ রোড) হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
৩. রেইনবো এফডিসি থেকে রাসেল স্কয়ার অভিমুখী যাত্রীবাহী বাস সোনারগাঁও ক্রসিং থেকে বামে মোড় নিয়ে বাংলামোটর দিয়ে শাহবাগ হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
আমন্ত্রিত অতিথিদের যাতায়াতের পথ:
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, ধানমণ্ডি-২৭ মেট্রো শপিংমল থেকে ডানে মোড় নিয়ে আহছানিয়া মিশন ক্রসিং থেকে বামে মোড় নিয়ে ৩২নং পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছাবে।
পার্কিং:
১. ধানমণ্ডি-৩২ নং ব্রিজের উত্তরের ১১নং রোডের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্ত (পতাকাবাহী, পিজিআর, এসএসএফ, ফায়ার সার্ভিস, বাহিনীর প্রধানসহ আইজিপি ও সিনিয়র সচিব/সচিব পদমর্যাদার সব গাড়ি)।
২. ৩২ নং ব্রিজের দক্ষিণে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সব গাড়ি।
৩. আহছানিয়া মিশনের উত্তর রাস্তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব গাড়ি।
শোক দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দিবসটির শুরুতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সর্ব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।
এছাড়াও কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল সাড়ে ৬ টায় ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও ৮ টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ই আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনসহ ফাতেহা পাঠ,মোনাজাত ও দোয়া মাহফিলের অয়োজন করবে আওয়ামী লীগ। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ,সহযোগী সংগঠনসহ মহানগরের প্রতিটি নেতাকর্মীরা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে।
এছাড়া দুপুর ১২ টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন,ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
উক্ত কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল,গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাদ জোহর কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
মন্দির,প্যাগোডা,গির্জা,উপাসনালয়ে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে (রাত ১২ টা ১ মিনিট) মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে (৩/৭-এ সেনপাড়া, পর্বতা, মিরপুর-১০) মোমবাতি প্রজ্বলন ও বিশেষ প্রার্থনা,সকাল ৯টায় তেজগাঁও হলি রোজারি চার্চে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করেছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়,সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডাস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছে। দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ মানুষদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে।
এছাড়াও ১৬ আগস্ট বিকেল ৪ টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবসের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করবেন এবং বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদা এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে পালনের জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্থাসমূহের সকল স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক, দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
একইসাথে দলের সকল জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সমস্ত শাখার নেতৃবৃন্দকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন উপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ করে দিবসটি স্মরণ ও পালন করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।