শিশু আলো হত্যায় ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড
সারাদেশ ডেস্ক
কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে চাঞ্চল্যকর শিশু মো. আলী উল্লাহ আলো (৭) হত্যা মামলায় ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১১ মে) বিকালে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় প্রদান করেন।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. সুমন আলী (মো. সুমন হোসেন পলাতক), পিতা-মো. আফতার আলী প্রকাশ আতাব আলী প্রকাশ আকতার, সাং-খোদ নারায়নপুর, থানা- মহাদেব পুর, জেলা-নওগাঁ, মো. ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান, পিতা-মৃত শামছুল হক, সাং- নিশ্চিন্তপুর, থানা ও জেলা-ঠাকুরগাঁও, মো. ইয়াকুব, পিতা-মৃত আসলাম মিয়া, সাং-শ্রীপুর, থানা-চৌদ্দগ্রাম, জেলা-কুমিল্লা, মো. ইছহাক প্রকাশ কালু, পিতা-আলী হোসেন, সাং-গোদারবিল, থানা-টেকনাফ, জেলা-কক্সবাজার, নজরুল ইসলাম (পলাতক), পিতা-মৃত নবী হোসেন, সাং-মহেশখালিয়া পাড়া, থানা-টেকনাফ, জেলা-কক্সবাজার ও ছৈয়দুল আমিন প্রকাশ লম্বাইয়া (পলাতক), পিতা-মৃত আবদুর রহিম, সাং-ধুনচি পাড়া, থানা-মংডু, জেলা-আকিয়াব, মিয়ানমার, বর্তমান ঠিকানা-শ্বশুর মৃত আবদু ছাত্তার, সাং-কচুবনিয়া, থানা-টেকনাফ, জেলা- কক্সবাজার।
রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। রায়ে আসামি মুহিবুল্লাহ ও মো. দিদার মিয়ার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তাদের বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন।
এসময় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মো. ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান, মো. ইছহাক প্রকাশ কালু ও ইয়াকুব আদালতে হাজির ছিল। তাদেরকে সাজা পরোয়ানা মূলে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে সুমন আলী, ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান, ইয়াকুব, ইছহাক প্রকাশ কালু, নজরুল ইসলাম এবং ছৈয়দুল আমিন প্রকাশ লম্বাইয়াকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
মামলার বিবরণীতে জানা যায়, ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬ টার দিকে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদার বিল এলাকার রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও ফারজানা পারভীন সুইটি’র ৭ বছরের শিশু পুত্র মো. আলী উল্লাহ আলোকে আবদুল্লাহর কর্মচারী মো. সুমন আলী বাড়ির সামনের কাচারি ঘরে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবী করার উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে যায়। পরে পাখির বাসা দেখানোর কথা বলে মো. আলীকে আবদুল্লাহর কাচারি ঘরের সিলিং উপর তুলে তার হাত পা বেঁধে মুখে জোর করে টেপ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এসময় মো. আলী উল্লাহ আলো চিৎকার করলে আসামী মো. সুমন আলী ও অন্যান্যরা আলীকে সিলিংয়ের উপর জবাই করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় আলী উল্লাহ আলো’র পিতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাদী হয়ে ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৫ জন আসামীর নাম উল্লেখ ও ৪/৫ জনকে অজ্ঞাত আসামী দিয়ে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি পর্যায়ক্রমে টেকনাফ থানার এসআই মাহবুবুর রহমান, এসআই হারুনর রশীদ এবং টেকনাফ থানার ওসি (তদন্ত) স্বপন কুমার মজুমদার তদন্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। এ চার্জশিটের বিরুদ্ধে বাদী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর আদালতে নারাজি আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত বাদীর নারাজির আবেদন গ্রহণ করেন এবং ২০১৪ সালের ৪ মার্চ মামলাটি সিআইডিকে অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশে পর্যায়ক্রমে সিআইডি’র চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু, সহকারী পুলিশ সুপার এস.এম সাহাব উদ্দিন আহমদ এবং সর্বশেষ সিআইডি চট্টগ্রাম মেট্টো জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির সরকার তদন্ত করে গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট এজাহারভুক্ত ৫ জন সহ ৮ জন আসামির নাম উল্লেখ করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/১০৯/১১৪ ধারায় আদালতে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করেন।
সম্পূরক চার্জশীটে এজাহারভুক্ত ৫ জন আসামী যথাক্রমে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার কোদ্দ নারায়নপুরের মৃত আফতাব আলীর ছেলে মো. সুমন আলী (২৬), ঠাকুরগাঁও জেলার নিশ্চিন্তপুরের মৃত শামছুল হকের ছেলে ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান (২৯), কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের শ্রীপুরের মৃত আসলাম মিয়ার ছেলে মো. ইয়াকুব (৩৪), টেকনাফের গোদার বিল গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে মো. ইসহাক প্রকাশ কালু (৩১), টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়ার মৃত নবী হোসেনের ছেলে নজরুল ইসলাম (২৮)।
এছাড়া তদন্তে প্রাপ্ত এজাহার বহির্ভূত আরও ৩ জন আসামী যথাক্রমে মিয়ানমারের মংডু থানার ধনচি পাড়ার মৃত আবদুর রহিমের ছেলে রোহিঙ্গা ছৈয়দুল আমিন প্রকাশ লম্বাইয়া (৪৭), টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়ার মৃত মৌলভী আবদুল জলিলের ছেলে মহিবুল্লাহ (৪৫), টেকনাফ পৌরসভার লেঙ্গুরবিলের জাফর আহমেদের ছেলে মোঃ দিদার মিয়ার (৩৫) বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়।
মামলাটি টেকনাফের আমলি আদালত থেকে বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়। মামলার ৩ জন আসামী যথাক্রমে মো. সুমন আলী, ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান ও মো. ইয়াকুব ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী প্রদান করেন। ২০২০ সালের ২৪ জুলাই কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি চার্জ গঠন করে বিচারকার্য শুরু করেন।
মামলায় ২৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তাদেরকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেন। এরপর আলামত প্রদর্শন ও পর্যালোচনা, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যাচাই, ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন যাচাই, তিন জন আসামীর ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দী যাচাই, আসামীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যুক্তিতর্কসহ সকল বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মামলাটি বুধবার রায় ঘোষণা করা হয়।