শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Homeকক্সবাজার সদরকেন ভাঙছে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত?

কেন ভাঙছে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত?

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভেঙে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সৈকতের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্টসহ একাধিক স্থানে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেন ভাঙছে সমুদ্রসৈকত, ভাঙন থেকে উত্তরণের উপায় কী—এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পর্যটন ও স্থানীয়রা। তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিদ্যা ইনস্টিটিউটের (ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস) সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ঘনঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে বড় বড় ঢেউ উপকূলে শক্তিশালী হয়ে আছড়ে পড়ছে। উচ্চ শক্তির এই ঢেউ উপকূলের বালু সরিয়ে দেওয়ায় সৈকতে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় সমুদ্র স্রোতের প্রকৃতি ও ঢেউয়ের তীব্রতা অন্যরকম বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া মানবঘটিত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি, শীতের সময় প্রচুর পলি ও বালু নানা নদ-নদীর দ্বারা বাহিত হয়ে বাংলাদেশ উপকূলে জমা পড়ে। আর বর্ষায় সেই পলি ও বালু মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সৃষ্টি ঢেউয়ের আঘাতে সরে যায়। পুনরায় শীত মৌসুমে জমা হয়। এ সাম্যবস্থা একটি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। উপকূলীয় অঞ্চলে এই পলি কিংবা বালু প্রবাহ যদি কোনও কারণে বিঘ্নিত হয়, তাহলে উপকূলে ভাঙন দেখা যায়। উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ভৌত অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে বালু প্রবাহ আটকে গেলে এবং উন্নয়নকাজে ভূমি ভরাটে সমুদ্রের উপকূল থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত বালু আহরণের ফলেও উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এমন কোনও কিছু ঘটছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।’

শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ‘সৈকত ভাঙনরোধে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত রক্ষায় পরিবেশবিজ্ঞানী, সমুদ্রবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সমন্বিতভাবে শক্তিশালী ও টেকসই উপায় বের করতে হবে। আমি বলবো, কক্সবাজারের উপকূল রক্ষায় সমুদ্রের স্রোত ও ঢেউয়ের প্রকৃতি ও ভূগঠনকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে জৈব-প্রকৌশল প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। একইসঙ্গে সমুদ্রপাড়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে পরিবর্তন আনতে হবে। সৈকতকে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সৈকত সুরক্ষায় পর্যটন ও পর্যটকদের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে। তা না হলে আগামীতে পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, ‘এখন বর্ষাকাল। মূলত, বর্ষাকালে সমুদ্র উত্তাল থাকে। প্রকৃতিক নিয়মে সমুদ্র একদিকে ভেঙে অন্যদিকে ভরাট হয়। এটি সমুদ্রের নিয়ম। কিন্তু, এবছর সমুদ্র উপকূল বেশি ভাঙছে এবং ভেঙে যাওয়ার চিত্রটি বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মৌসুমভিত্তিক সাগরের পানি বা ঢেউ সবসময় পরিবর্তন হয়। পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপাড় ভাঙতে পারে। সাগরের স্রোত ও ঢেউয়ের গতিপথ পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের ভাঙন হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূমণ্ডলীয় কারণে এখন বেশিরভাগ সমুদ্র ভাঙছে। শুধু সমুদ্রের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট নয়, সৈকতের অন্যান্য এলাকাও ভাঙছে।’

গত সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিকভাবে কক্সবাজারে সমুদ্রের পানির ঢেউয়ের তোড়ে ক্রমেই ভাঙছে পর্যটন সৈকত লাবণী ও সুগন্ধাসহ কক্সবাজার সৈকত বালিয়াড়ি। অস্বাভাবিক জোয়ারের তাণ্ডবে ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত সৈকত হারাচ্ছে চিরচেনা সৌন্দর্য। ভাঙনে ঝুঁকির মুখে রয়েছে সৈকতের ছাতা ও ঝিনুক মার্কেট।

গত শুক্রবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় ভাঙনরোধে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে অস্থায়ীভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন কবির বিন আনোয়ার।

সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘সমুদ্রসৈকতের ভাঙন ঠেকাতে একনেকে তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প জমা দিয়েছি। নাজিরারটেক থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ হবে। তখন হয়তো সাগরের ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে কক্সবাজার।’

এদিকে, ঢেউয়ের আঘাতে সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলীর ডলফিন মোড় পর্যন্ত ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। বড় বড় ঢেউয়ের তোড়ে বিভিন্ন এলাকার বালু সরে গেছে। তীব্র ভাঙনে সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি ও ঝাউ বাগান।

লাবণী পয়েন্টে জেলা প্রশাসন নির্মিত উন্মুক্ত মঞ্চ পর্যন্ত চলে এসেছে ভাঙন। কিছু কিছু জায়গায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জিওব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে কোনও কাজ হচ্ছে না। ইতোমধ্যে লাবণী পয়েন্টের বেশ কয়েকটি জিওব্যাগ সমুদ্রে চলে গেছে। ওই এলাকার ট্যুরিস্ট পুলিশের হেল্প ডেস্কও সমুদ্রে চলে গেছে।

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার / বাংলা ট্রিবিউন

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments