শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Homeশোকাবহ আগস্টবঙ্গবন্ধুর খুনিরা ১৫ মাস আগেই অভ্যুত্থান নিয়ে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছিল

বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ১৫ মাস আগেই অভ্যুত্থান নিয়ে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছিল

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের অন্তত ১৫ মাস আগে অভ্যুত্থান নিয়ে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছিল খুনিরা। এছাড়াও, অভ্যুত্থানের পর বিদেশি কোন শক্তি, বিশেষ করে ভারত যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেই দিকটা আমেরিকা দেখবে কিনা সেটাও যাচাই করতে চেয়েছিল তারা।
শুধু তাই নয়, এর আগেও তারা আমেরিকান দূতাবাসে যান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমেরিকা থেকে অস্ত্রকেনার লক্ষ্যে তথ্য জানতে। তখন তারা দেশে সেনা অভিযানে হস্তক্ষেপ ও দলীয় বিবেচনার বিষয় গুরুত্ব দেয়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের কথা সেখানে ব্যক্ত করেন।
আমেরিকান সাংবাদিক ও লখক বি জেড খসরু‘র ইংরেজিতে লেখা ‘দি বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু এন্ড দ্য সিআইএ লিঙ্ক’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। বাংলাদেশে দি ইউনিভার্সেল একাডেমি গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে।
বি জেড খসরু তাঁর গ্রন্থে লিখেন, ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস এমন অভ্যত্থানের কথা শুনেছিল ১৫ আগস্টের ঘটনার অন্তত ১৫ মাস আগে। ১৯৭৪ সালের ১৩ মে সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (বহিষ্কৃত) আগে থেকে না জানিয়েই আমেরিকান দূতাবাসের জনসংযোগ অফিসার উইলিয়াম গ্রেসামের বাসায় যান। ফারুক তাকে জানায় যে, উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি এসেছেন আমেরিকানদের মনোভঙ্গি সর্ম্পকে জানার জন্য। তিনি বলেন, তারা নিশ্চিত হতে চান সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহন করলে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে। ফারুক তাকে বলেন, বিদেশি কোন শক্তি যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে দিকটা আমেরিকা দেখবে কি না। ফারুক বিশেষ করে ভারতের কথা বোঝাতে চায়।
ফারুক গ্রেসামকে জানায়, সারা দেশে সেনা অভিযান চলাকালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ নেতাদের না ধরার জন্য যে আদেশ দিয়েছেন তাতে সেনাবাহিনী সরকারের উপর ভীষণ চটে আছে। গ্রেসাম ফারুককে জানান, আমেরিকা বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ করবে না। তবে, ফারুকের এই সাক্ষাতের বিষয়টি দূতাবাস ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে অবগত করে। তারা একে অস্বাভাবিক অ্যাপ্রোচ বলে আখ্যায়িত করে।
তারা বর্ণনা করে বলেন, গত দু’বছরে এটাই প্রথমবার সেনাবাহিনীর অসন্তোষ এবং ক্যু-এর খবর নয়। আগেও এমন কথা দূতাবাসের কানে এসেছে। কিন্তু এর কোনটাই সত্য হয় নাই। তারা আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমেরিকা থেকে অস্ত্র কেনার লক্ষ্যে তথ্য জানতে ফারুক ও রশীদ এক বছর আগে আমেরিকান দূতাবাসে যান। তখন তারা সেনা অভিযানে হস্তক্ষেপ ও দলীয় বিবেচনার বিষয় গুরুত্ব দেয়ায় সেনা বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করেন।
মার্কিন দূতাবাস ফারুকের এই সাক্ষাতের বিষয়টি যতই অস্বাভাবিক অ্যাপ্রোচ বলে আখ্যায়িত করুক না কেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ করবে না জনালেও পরবর্তী সময়ে তাদের কিছু তৎপরতা কিন্তু সেই অবস্থানকে প্রকাশ করে না। এধরনের খবরের নির্ভরযোগত্য যাচাইসহ অভূ্যূত্থানের সম্ভাব্য দিক নিয়েও বিস্তর চিন্তা ভাবনা চর্চা করতে দেখা গেছে তাদের। স¦ল্প মেয়াদে সেনাবাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রন নেয়ার সক্ষমতা আছে কিনা, অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা কিংবা জেলে নেয়া অথবা জোরপূর্বক বিদেশে পাঠানো হলে এর ফলাফল কি হতে পারে এসব নিয়েও তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল।
এ ব্যাপারে বি জেড খসরু লেখেন, এর আগেও আমেরিকান দূতাবাস ক্যু সংক্রান্ত খবরের অনেকগুলো রিপোর্ট পাঠায় ওয়াশিংটনে। তখন উল্লেখ করা হয় ২১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে সেনাআহিনী ক্যু ঘটাতে পারে। এই সব রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ স্টেট ডিপার্টমেন্ট এমন খবরের নির্ভরযোগ্যতা সর্ম্পকে জানতে চায় দূতাবাসের কাছে। তারা জানতে চানÑস্বল্পমেয়াদে সেনাবাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রন নেয়ার সক্ষমতা আছে কিনা , অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা কিংবা জেলে নেয়া অথবা জোরপূর্বক বিদেশে পাঠানো হলে এর ফলাফল কি হতে পারে? অভ্যুত্থান হলে শেখ মুজিব কি তাঁর নেতৃত্ব অভ্যুত্থান পরবর্তী নেতাদের হাতে ছেড়ে দেবেন? এইসব প্রশ্ন ছাড়াও স্টেটডিপার্টমেন্ট জানতে চায় অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হলেও কিংবা পরিকল্পনা আগে ফাঁস হয়ে গেলে বাংলাদেশ সরকারের গতি প্রকৃতি কি হবে? আমেরিকার জন্য এমন অভ্যুত্থানের প্রভাব কি হবে সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলে স্টেটডিপার্টমেন্ট। এতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’ধরনের সম্ভবনার কথাই বলা হয়। ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস ২২ মার্চ আট পৃষ্ঠার এক বিশ্লেষণে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রশ্নমালার জবাব দেয়। ডেপুটি চিফ অব মিশন আরভিং চেসলো উল্লেখিত মেয়াদের মধ্যে কেন অভ্যুত্থান ঘটতে পারে তার বিশ্লেষণ করে লিখেন, বাকশাল গঠিত হওয়ায় ভারতপন্থি ও সোভিয়েটপন্থি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টিকে সাথে নিয়ে শেখ মুজিবের ক্ষমতা সুসংহতকরণের আগেই হয়তো তারা অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। তবে, তাদের মধ্যে যেমন ধৈর্য্যহীনতা আছে, তেমনি আছে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়।
আমেরিকান কূটনীতিকগণ ধারণা করেছিলেন ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে যখন শেখ মুজিব বাকশাল গঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন তখন এই অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। তবে, অভ্যুত্থান চেষ্টার সম্ভাবনা নিয়ে চেসলোর সন্দেহ ছিল। তিনি লিখেন ‘আমাদের প্রশ্ন জাগেÑঅপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ তরুন অফিসারদের এমনটা করার আতœবিশ^াস কতটুকু আছে ? কতটা সক্ষমতা আছে এবং তাদের সহকর্মীদের উপর কতটা নির্ভর তারা করতে পারবে? অথচ এর উপরেই হয়তো নির্ভর করবে তাদের পরিকল্পনার সাফল্য।
অন্যদিকে চেসলো তার এই বিশ্লেষণে আবার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার দিকও বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেন, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে স্বল্পমেয়াদে দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার শক্তি থাকবে তাদের। তবে, তাদের সফলতার শর্ত হবে শেখ মুজিবকে জিম্মায় নেয়ার পর সেনাবাহিনীর ঐক্য বজায় রাখা। যদি, তাদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয় এবং উপদলীয় কোন্দল প্রাধান্য পায় তাহলে তারা কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হবে। আর যদি তারা একত্রে মিলে একে সফল করে তাহলে বাঙালি জনগণ তাদের পক্ষে এসে দাঁড়াবে।
তবে, রিপের্টে ২১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে সেনাবাহিনী ক্যু ঘটাতে পারে বলা হলেও ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। পঁচাত্তরের শোকাবহ এই কালরাতে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে সেদিন একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
এ নিয়ে আমেরিকান দূতাবাস প্রেরিত স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি গোপন দলিলে বলা হয়েছে, ক্যু এর পরিকল্পনা হয়েছে সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে। রিপোর্টে বিশদ কিছু না থাকলেও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ঘটনা ঢাকায় আমেরিকান এক্সপ্রেসে কর্মরত ফিনলে মোদি তার কোম্পানিকে লিখে জানান যে, জুনিয়র সেনা অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত এই অভ্যুত্থান দক্ষিণপন্থি ও ইসলামপন্থিদের বলে মনে হয়। এতে অধিকাংশ সেনার কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সেনাবাহিনী বিভক্ত হয়ে আছে। ভবিষ্যতে এর বিরুদ্ধে পাল্টা ক্যু হতে পারে। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত তার কোম্পানির সদর দপ্তরে পৌঁছে দেয়ার জন্য ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস তার এই বার্তাটি ওয়াশিংটনে পাঠায়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments